বস্টনে বাইরের তাপমাত্রা যখন শূন্যের ঘরে তখন একগুচ্ছ তরুণ-তরুণীর অকুন্ঠ উৎসাহ-উদ্দীপনায়, অক্লান্ত পরিশ্রমে, ও অনবদ্য পরিচালনায় গত ১৮ই জানুয়ারী এক অভিনব মেলা বসেছিল বস্টনের কাছের শহর ফ্রেমিংহ্যামে একটি চার্চে। একটি নতুন গোষ্ঠী ‘দিশারী’ প্রথমবার এই পৌষ মেলার আয়োজন করেছিল।
মেলার প্রবেশপথের তোরণ সাজানো হয়েছিল কুলো, হাতপাখা, পটচিত্র ও যামিনী রায়ের ছবি দিয়ে। সেখানে খড়ের চাল দেওয়া মাটির কুঁড়েও দেখা যাবে। মেলায় ঢুকলেই শোনা যাচ্ছিল রবি ঠাকুরের অতি পরিচিত ‘পৌষ তোদের ডাক দিয়েছে আয় রে ছুটে আয় – শান্তিনিকেতনে পৌষ মেলার আভাস নিয়ে। বলা বাহুল্য যে এসব উদ্যোক্তাদের বাঙ্গালি রুচি ও শিল্পের প্রতি ভালবাসার পরিচায়ক।
আয়োজকরা চার্চের জিমনেসিয়ামকে সাজিয়েছিল সোনাঝুরির মাঠের সাজে। সার সার দোকান বসেছে চারদিক ঘিরে। সেখানে কি নেই? মনিহারীর দোকান, শাড়ি গয়নার দোকান, নানারকমের দেশী খাবার আর মিষ্টির দোকান। এমনকি ফুচকা, আলুকাবলি, চাটের দোকানও বাদ যায়নি। আর সেখানে ভিড়ে ভিড়ে একাক্কার।
তবে সংস্কৃতিও বাদ যায় নি। হাতে আঁকা ছবি ও হস্ত-শিল্প ও কুটির শিল্পেরও স্টল ছিল তিনটি। তার মধ্যে হাতে আঁকা ছবির সম্ভার নিয়ে বসেছিল আমাদের দেবজ্যোতি ও আর এক ভদ্রমহিলা। আর স্বাতীর সঙ্গে ছিল হস্ত- ও কুটির শিল্প। রাহুল ও আমিও একটা স্টল দিয়েছিলাম আমার হাতে করা কিছু ভাস্কর্য ও অন্যান্য হাতের কাজ ও রাহুলের আঁকা ছবির ক্যানভাস নিয়ে।
এসবের মধ্যে ছিল আবার দুটো বইয়ের স্টল। আমাদের চিত্রভানু আর রুমা প্রধানতঃ বাংলা বই নিয়ে দোকান সাজিয়ে বসেছিল। শুনলাম মেলা দেখতে এসে জনগণ বেশ কিছু বইও কিনে নিয়ে গেছে। বিক্রেতারা অবশ্যই খুশি। এর পাশেই ছিল ‘লেখনী’-র স্টল। লেখনী একটি বাংলা সৃজনশীল লেখার গোষ্ঠী। গৌরী দত্তের পরিচালনায় প্রায় ২৫ বছর এই গোষ্ঠীটি সক্রিয় রয়েছে। এই টেবিলে ছিল লেখনী-র সঙ্গে যুক্ত লেখক-লেখিকাদের লেখা বই ও লেখনীর চারটি অ্যান্থলজী। সেখানেও দর্শকদের ভিড় কম হয়নি। এমনকি কিছু বই বিক্রিও হয়েছে, যার মধ্যে আমার ও রাহুলের বই আছে।
আমাদের সন্দেহ ছিল এই মেলায় কতোই বা লোক আসবে। এ দেশের নিয়ম অনুযায়ী ওই চার্চে ৩০০ জনের বেশি লোক ঢোকানো যেতো না। আর এই মেলা ছিল সম্পূর্ণ ভর্তি। কয়েক সপ্তাহ আগে উদ্যোক্তারা এই মেলা প্রসঙ্গে আমাদের একটা ভিডিও ক্লিপ দিতে বলেছিল। সেটা দেখে আমাদের পরিচিত কিছু মানুষ আসতে চেয়েছিল মেলায়। কিন্তু তারা টিকিট পায়নি। আমাদের কাছে এটা একটা মস্ত বিস্ময়। বলে কি? এদেশের পৌষ মেলায় হাউস ফুল?
জিমনেশিয়াম লোকে ভর্তি। হঠাৎ অনেকখানি জায়গা খালি করা হল আর লাউড স্পীকারে ভেসে এলো – পৌষ তোদের ডাক দিয়েছে আয় রে ছুটে আয়, ধিতাং ধিতাং বোলে, এই মাদলে তান তোলে, গ্রাম-ছাড়া ওই রাঙা মাটির পথ – ইত্যাদি গান। সঙ্গে সঙ্গে শুরু হল কোমরে শাড়ি জড়িয়ে নিয়ে মেয়েদের একসাথে নাচ। আর একটা আশ্চর্যজনক ব্যাপার – এখানে বাংলার সঙ্গে একটাও হিন্দি গান ছিল না। ভাবা যায়! দর্শকদের মধ্যেও অনেকে যোগ দিল! সব স্বেচ্ছাসেবীরা দেখলাম রঙিন কাঁথাকাজের শাড়ি, ধুতি-পাঞ্জাবি পড়েছে। রঙিন প্রজাপতিদের প্রানোচ্ছল নাচ দেখে শান্তিনিকেতনের কথাই বার বার মনে পড়ছিলো।
জিমনেসিয়ামে নাচ শেষ হওয়ার পর, সঙ্গে লাগোয়া মস্ত অডিটোরিয়ামে শুরু হল বিচিত্রানুষ্ঠান। তাতে ছিল কয়েকটি গান ও নাচের অনুষ্ঠান। আমাদের কানেকটিকাটের বন্ধু কস্তুরী, গিরিজা ও সহ-শিল্পিরা একটা চমৎকার লোক-গানের অনুষ্ঠান পরিবেশন করে। আমাদের আর এক বন্ধু সৌমিত্রের গানের স্কুল থেকে ছোটদের মনোজ্ঞ অনুষ্ঠান করা হয়। আমাদের গোষ্ঠী ‘সং বার্ডস্’ (প্রতীক, আশিষ, মমতা, গিরিজা, রাহুল ও স্বপ্না)-এর পক্ষ থেকে পরিবেশন করা হয় ‘লোকগান, রবীন্দ্রনাথ ও বর্তমান’ – রবীন্দ্রনাথের গানের দেশজ উৎস থেকে আজকের দ্রোহের কালের গানের অনুপ্রেরণা।
এই সমস্ত নাচ ও গানের মধ্যে ছিল একেবারে ব্যতিক্রমী একটি অনুষ্ঠান – বাংলা সাহিত্য বাসর। আমাদের বন্ধু অলকেশের আমন্ত্রনে আমরা (অলকেশ, মহুয়া, রাহুল, স্বপ্না, জয়ন্ত ও শান্তা) ষ্টেজে চেয়ারে বসলাম, আর পরিচালক অলকেশ কথার বুনুনী দিয়ে একের পর এক জনকে ডাকল তাদের কবিতা, আত্ম-চরিত, ও বিভিন্ন লেখা পড়ার জন্য। আর মধ্যে মধ্যে চলল অলকেশের চমৎকার ‘একের সঙ্গে আর এক জুড়ে দেওয়া’ কথন। সব শেষে শান্তা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একটি কবিতা গেয়ে শোনাল। শ্রোতা-দর্শকরা শান্ত হয়ে আমাদের অনুষ্ঠান শুনেছেন। অ্যামেরিকায় একটা মেলায় বাংলা সাহিত্যের আসর। ভাবা যায়!
একটা চমৎকার অনুভুতি নিয়ে আমরা বাড়ি ফিরলাম। বস্টনে আমাদের বাংলাদেশের বন্ধু তাপসের উদ্যোগে এই ধরণের মেলা আগে একবার হয়েছে। কিন্তু পশ্চিম বাংলার বাঙ্গালিদের উদ্যোগ ও আয়োজনে এরকম পৌষ মেলার অনুষ্ঠান বস্টনে একেবারে প্রথম। আমি যতদূর জানি এ দেশেও প্রথম। ‘দিশারী’-র সংগঠক ও কর্মীদের সবাইকে আমি চিনিনা। তবু যাদের চিনি – সুলগ্না, স্বাধীনা, রঞ্জিনী, পান্না, মৌপর্ণা, সঞ্জিত, বুদ্ধ, শুভায়ু, ও অন্য যাদের চিনিনা- তাদের সবায়ের জন্য রইল অকুণ্ঠ ধন্যবাদ। আবার এরকম আয়োজনের দিকে তাকিয়ে রইলাম উন্মুখ হয়ে।
ছবির জন্যে রঞ্জিনী কে বিশেষ ধন্যবাদ!